বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একজন উত্তরসূরী অভিযোগ করেছেন, আজকের ভারতে একজন ‘হিন্দু কবি’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে তাকে চরম অবমাননা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের জাতীয় কবির প্রপৌত্র ও লেখক-গবেষক অঙ্কন কাজী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় এক নিবন্ধে লিখেছেন, নজরুলের লেখালেখিতে দেশের হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর দৃষ্টি পড়েছে, এবং সেই ইঙ্গিত অত্যন্ত বিপজ্জনক।
বিজেপি অবশ্য দাবি করছে তারা আদৌ কখনও নজরুলকে হিন্দু কবি হিসেবে দেখেননি।
তবে তারা তাঁকে একজন মুসলিম কবি হিসেবে তুলে ধরারও বিরোধী।
ভারতে শাসক দল বিজেপি-র আদর্শিক অভিভাবক বলে পরিচিত আরএসএস সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা কাজী নজরুলের কবিতা হিন্দিসহ নানা ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করবে।
নামে মুসলমান হলেও জীবনযাপনে তিনি কীভাবে হিন্দু সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, বইগুলোতে সেই তথ্যও তুলে ধরা হবে সংক্ষেপে।
আর সঙ্ঘের এই ঘোষণাতেই অশনি সংকেত দেখছেন কবির পরিবারের অন্যতম উত্তরসূরি, লেখক-গবেষক অঙ্কন কাজী।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গে নজরুলকে নিয়ে নতুন নানা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, তার কবিতা অনুবাদ করে আরও মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে – এটা তো ভাল খবর। কিন্তু যারা এগুলো করছেন, তার মধ্যে তাদের একটা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা আছে বলেও মনে হচ্ছে। কারণ তারা নজরুলকে হিন্দু কবি হিসেবে তুলে ধরতে চান।”
“অথচ যারা নজরুলের পাঠক, তারা জানেন হিন্দু-মুসলিমের দৃষ্টিকোণে তাঁর কবিতাকে মাপা হলে তার প্রতি বিরাট অবিচার করা হবে। বহু বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি, সেগুলো সব এড়িয়ে গিয়ে তাকে যদি একজন হিন্দু কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেটা আমার মতে খুবই গড়বড়ে ব্যাপার।”
কিন্তু বইগুলো বাজারে বেরোনোর আগেই কেন এই আশঙ্কা?
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মি. কাজীর মতে, আসলে এই উদ্যোগের পেছনে যে সংগঠনগুলো আছে তাদের ইতিহাস দেখলে নিশ্চিন্ত থাকার কোনও কারণ নেই।
“বিজেপি-আরএসএস প্রভাবিত এই সংগঠনগুলোর কাজের প্যাটার্নের সঙ্গে আমরা পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে পায়ের তলায় জমি পেতে তারা যে নানা সাংস্কৃতিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সেটাও অজানা নয়।”
“এখান থেকেই আভাস মেলে যে তাদের বৃহত্তর পরিকল্পনা হল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে নিজের সুবিধামতো কাজে লাগানো”,বলছিলেন তিনি।
কিন্তু বিজেপি কি সত্যিই নজরুলকে একজন হিন্দু আইকন হিসেবে দেখতে চায়?
এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গে দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য দাবি করছেন, কংগ্রেস তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেও বিজেপি চিরকালই নজরুলকে অসাম্প্রদায়িক চোখে দেখে এসেছে।
তিনি বলেন, “বরং দুর্ভাগ্যজনক হল আজ নজরুলকে একজন মুসলমান হিসেবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। আর বিজেপি বা আরএসএস কখনওই তার হিন্দু পরিচয় তুলে ধরতে চায়নি। তবে কংগ্রেস যে তাকে চরম হেনস্থা করেছিল সেটা আমরা সব সময়ই বলে এসেছি।”
“নজরুলের একমাত্র অপরাধ, তিনি ছিলেন কংগ্রেসের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি খিলাফত আন্দোলনকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার গান্ধীজীর সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। নজরুল একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদীর মতো তখন বলেছিলেন এতে সর্বনাশ হয়ে যাবে”, বলছেন শমীক ভট্টাচার্য।
পাশাপাশি বিজেপির পূর্বসূরি জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিই যে বারবার নজরুলের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং নজরুলকে মুসলমান হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে বলে মি. ভট্টাচার্য যে পাল্টা অভিযোগ তুলছেন, তাতে সত্যতা কতটা?
ঐ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, কবি সুবোধ সরকারের মতে, নজরুল চিরকালই সম্প্রীতির প্রতীক ছিলেন ও থাকবেন।
তার কথায়, “নজরুলকে নিয়ে চিরকাল আমরা যে ধারণাটা লালন করে এসেছি তা হল একজন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তিনি কালীভক্ত, তিনি শ্যামাসঙ্গীত লেখেন। তিনি সত্যি সত্যিই এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন যে আমরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম। নিজের পারিবারিক জীবন দিয়েও তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন।”
“উত্তর-আধুনিক ভারতে আজ যে ধর্মান্ধতা বা বিভাজনের রাজনীতি চলছে, তাতে আমার মনে হয় নজরুলই হতে পারেন সেই মেটাফোর যা এই বিভেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। তার ভূমিকাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করলেই তো চলবে না।”
“আমি নিশ্চিত যে রাজনীতিবিদরাই সেই চেষ্টা করুন, নজরুলকে হিন্দু কবি হিসেবে তুলে ধরার থিওরি আদৌ টিকবে না। কেউ সেটা মানবে না।”
মৃত্যুর ৪১ বছর পরেও নজরুলের কবিতা যে নানা ভাষায় অনুবাদ হতে যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় যে তার আকর্ষণ এখনও অটুট।
কিন্তু তার পাশাপাশি কবির ধর্মীয় সত্ত্বা নিয়ে এই বিবাদ ভারতে তার লেগ্যাসি নিয়ে নতুন বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে।
সূত্র, বিবিসি বাংলা